রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২০২২ সালে দায়সারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সেখানকার ওয়াহেদ ম্যানশন থেকে আশপাশে আগুন ছড়িয়ে ৭১ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর এখনো দিন কাটে সেই রাতের বিভীষিকা মাথায় নিয়ে। অথচ যেখানে মালিকপক্ষ রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাহিরে। চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ আশরাফ বলেন, বর্তমানে পেন্ডিং কোনো মামলা নেই। তাছাড়া আমি নতুন ওসি হিসেবে যোগদান করেছি। পুরোনো কোনো মামলার ব্যাপারে আমার ভালো করে জানা নেই।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ভবনে হঠাৎ আগুন লেগে তা ছড়িয়ে পড়ে আগুনে ৭১ জনের মৃত্যু হয়। অথচ তিনটি লাশের পরিচয়ও এখনো মেলেনি। চকবাজারের নন্দকুমার সড়কের মোড়ে চুড়িহাট্টায় ওইদিন রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনসহ আশপাশের ভবনে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা অবৈধ কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ আগুনে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেট কার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি, মোটরসাইকেলসহ শতাধিক যানবাহন পুড়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। নিমেষে চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে মৃত্যুকূপ। এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নারী-পুরুষ পুড়ে মারা যান। অনেকে মারাত্মক দগ্ধ হন। এ ঘটনার পরদিন এলাকার বাসিন্দা মো. আসিফ চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলায় ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেলসহ অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়।
এ ব্যাপারে সরজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে আশে পাশের মানুষ ওয়াহেদ ম্যানসন এর মালিক হাসান ও সোহেলের কোনো তথ্য দিতে পারেনি। যদিও হাসান থাকেন তৃতীয় তলায় আর সোহেল থাকেন চতুর্থ তলায়। ওয়াহেদ ম্যানসন এর নতুন দারোয়ান সুজন এর কাছে জানতে চাইলে সে বলেন স্যাররা কখন আসেন কখন যান বলতে পারবো না। স্যাররা মাঝে মাঝে বাসায় আসেন। স্যাররা একজন থাকেন ধানমন্ডি আর একজন থাকেন উত্তরা। ওয়াহেদ ম্যানসনের মালিক হাসানের ছেলে রাজ নিচু তলায় একটি দোকান নিয়ে ব্যবসা করেন কিন্তু তাকেও পাওয়া যায়নি। তিনদিন যাওয়ার পরও তার দোকান বন্ধ থাকায় রাজকে পাওয়া যায়নি। হাসান সাহেবের একটি ফোন নাম্বার পাওয়া গেলেও ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। তাই ওয়াহেদ ম্যানসন এর মালিক পক্ষের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। ২০১৯ সালে ৭ এপ্রিল হাসান ও সোহেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে তারা জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেলেও তাদের ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আশপাশের কেউ তাদের ঠিকানা দিতে পারছে না। মৃত ৭১ জনের মধ্যে ৬৭ জনের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রস্তত করা হয়েছিল। তাছাড়া তিনজনের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি। মামলার বাদী আসিফের অভিযোগ-মামলা তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তাকে জানানো হয় না। আগুনে পুড়ে আসিফের বাবা জুম্মন মারা গেছেন। আসিফ বলেন, সুষ্ঠু বিচার পেলাম না। এমনকি সরকার কিংবা অন্য কারও পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের কোনো খোঁজখবরও নেয়া হয় না। ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার পুরোটা পাইকারি ও খুচরা প্লাস্টিক জিনিসপত্রের কাঁচামালের দোকান ও গোডাউন ছিল। বিভিন্ন প্রসাধনীর গোডাউনও ছিল সেখানে। এলাকাটা মূলত প্লাস্টিক কাঁচামালের দোকান ও গোডাউন। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। বারবার ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও তেমন বদলায়নি পুরান ঢাকার দৃশ্যপট। ঘনবসতিপূর্ণ আর ঘিঞ্জি এলাকার অনেক বাসাবাড়ির নিচে এখনও ঝুঁকিপূর্ণভাবে নানা ধরনের কেমিক্যাল সামগ্রী তৈরি করা হচ্ছে।
অনেক বাসার নিচে গুদামও রয়েছে। অনেকেই বলছেন, দ্রুত দৃশ্যপট না বদলালে হয়তো বারবার এমন কঠিন পরিস্তিতির মুখোমুখি হতে হবে। চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার বিভিন্ন অংশ থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা সরানোর দাবি নতুন করে আলোচনায় আসে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা ছয়টি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিগুলোর সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-আবাসিক এলাকা থেকে গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেয়া এবং অনুমোদনহীন কারখানার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। কিন্তু সব সময় প্রধান বাধা আসে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেই। নানা যুক্তি দেখিয়ে তারা সেখান থেকে কারখানা সরাতে চান না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পুরান ঢাকায় এ মুহূর্তে প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক এবং প্লাস্টিক কারখানা ও গুদাম আছে। অগ্নিকাণ্ডের পর তাৎক্ষণিকভাবে অস্থায়ী ভিত্তিতে চকবাজারের কয়েকশ’ রাসায়নিকের কারখানা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখনও সেখানে ২৪০টির বেশি প্লাস্টিক কারখানা ও গুদাম রয়েছে চকবাজার এলাকায়। হতাহতের দিক থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৫টি অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে দুটি অগ্নিকাণ্ডের মামলা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দোষীদের চিহ্নিত করা গেলেও তারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মালিকপক্ষের অবহেলায় বিভিন্ন অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি অনেক বেড়েছে।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৯সালে ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে চকবাজার মডেল থানার চুড়িহাট্টা শাহি জামে মসজিদের সামনে প্রাইভেট কারের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে পাশের বিদ্যুতের ট্রান্সমিটারে আগুন লাগে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত মজুদ বডিস্প্রে, পলিথিনের দানা ও কেমিক্যালে আগুন ধরে যায়। ভয়াবহ আগুনে ৬৭ জন ঘটনাস্থলে মারা যায়। এ ঘটনায় স্থানীয় আসিফ মামলা করেন। মামলায় দুই আসামির নাম উল্লেখ করা হয়। ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল আসামি হাসান ও সোহেল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। বর্তমানে তারা জামিনে আছেন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

চকবাজার ট্র্যাজেডি * মালিকপক্ষ ধরাছোঁয়ার বাহিরে * অবৈধ কেমিক্যাল বাণিজ্য চলছে
জমা পড়েছে দায়সারা প্রতিবেদন তিন লাশের পরিচয় মেলেনি
- আপলোড সময় : ০৪-০৫-২০২৫ ০৮:০৯:৩৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৪-০৫-২০২৫ ০৮:০৯:৩৫ অপরাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ